গুচ্ছকবিতা । বদরুজ্জামান আলমগীর
নিউজ টাইমস ২১ ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ৩০ মার্চ ২০২১, ৬:৪৫:০০ অপরাহ্ন
সাতপুরুষের ঘড়া
শ্যাম অঙ্গে তোলো নারী দ্বিধাকাঞ্চন ভরা
সঙ্গোপনে মেলে ধরো সাতপুরুষের ঘড়া।
পানপাতা মহুয়া নারী চন্দ্রাবতী কলা
ধানদুর্বা বিন্নিনিধির মঙ্গাজল তোলা।
শ্রাবণে সে ঘোরলাগা রহস্য শহর
কোশা নৌকায় ধ্যান করে তোমার নাগর।
অনিয়ম পায়ে এসো মৎস্যগন্ধা মায়া
নুন্নির মূলে খাড়া ভাটি গাঙ্গের নাইয়া।
নিদারুণে আশা এই লগ্নির ভাগ লৈয়ো
শস্যবতী হাতের কড়ি দুঃখসমান আয়ু।
আকালের হাওয়া বসে বিরান খামার
আনো ঘরে দুধভাত কিষাণী আমার।।
চিত্রনাভি
তোমার অন্তরীক্ষে আমি উড়ানিয়া পাতাঝরা দেখি,
এ-কী আমার একাকী চোখের ভুল-
না-কী নতজানু এক অগ্নি উপাসকের
দিগন্তের দিকে ফেরা?
তোমার দিকে চাইলেই মনে হয়,
প্রজাপতির লাস্য, ট্রেনের নিচে কাটাপড়া রাত,
চোখের আড়ালে আতঙ্কিত সারসের অঞ্চল
আমাকে ইতিহাসের গ্রীবার দিকে টানে।
সিটি দিয়ে যায় জলে বোনা নিজস্ব ধুলার রেলগাড়ি,
সত্যে কী জমা হয়- ঝিনুকের নাভিমূলে মৃত
রাজকুমারের করোটীর হাড়?
চলো পাখি সুদর্শণা, উড়ে যাই হিম কীর্তনের
রক্তজবা ফুলে, ধৃতরাষ্ট্রের মূল ও ধূলি সন্ন্যাসে
কার্তিকের নবারুণ ঊষাদিনের সন্তাপে।
অপেক্ষাসংহিতা
তুমি যে গেলা ঘাড়ের গামছাখান নিবারও সময় পাইলা না। প্রথম প্রথম বালিশের উয়ারের ভিতর গামছা থুইয়া রাখতাম- গামছার লাগি বকা দিও না- যেভাবে মাস যায়, বছর গড়ায় তুমি আসো না- তয় গামছা দিয়া কী হবে! তোমার লাগি- এক কড়াও মিছা কই না- খালি তোমার লাগি মন উতলা হয়! ক্যান এমন হয়, আমি তার এক গণ্ডাও কইবার পারি না; নয়া পানির লাহান ফিইরা ফিইরা তুমি বারবার কও- আমার শরীলে নাকি কামরাঙ্গা ফলের ঘেরাণ! আমি কই- না গো না,আমি মাটির ফুফাতো বোইন; যদি তোমার দুর্দিন হয়, নাওয়ের বাইনের লাহান কোনদিন ভাইঙ্গা ভাইঙ্গা পড়ো- আমার মইধ্যে ভরসা রাইখো- তুফানে টলুম না, ঠাডায় কাঁপি না- আমি আড়ালে আবডালে দুপচাপিয়ার বাইদ।
কতোদিন হইয়া গেল- কতো বছর- চোখের জ্যোতি কইমা গ্যাছে- কোনকিছু ভাল কইরা ঠাহর করি না! লোকে হাসাহাসি করে, তা-ও একখান চশমা নিছি; একটাই আশা- তুমি যখন আসবা চোখ ভইরা দেখুম! তুমি অবুঝ, ক্যান বোঝ না- কতোদিন ধইরা তোমার পথ চাইয়া থাহি। মানুষের মন কে বুঝিতে পারে- হাত্তিরও পিছলে পাও, সুজনেরও ডুবে নাও! চিনাইয়ের ছাপ-দেওয়া যে শাড়িখান দিছিলা-আজো আমি তার ভাঁজ খুলি নাই! পইরা কী লাভ- কারে দেখামু? আমার চুল সাদা হইয়া গ্যাছে বইলা তুমি বুঝি আমারে চিনতে পারো না? ভাবো, খেজুরদানা গাঙ্গের পাড়ে আরেকটা ঢেউ খাড়াইয়া থাহে! হ, হ, তোমারে ডুবানির লাগি আরেকটা ঢেউ খাড়াইয়া আছে! একটা ঢেউয়ের লগে যেমন আরেকটা ঢেউয়ের একজনম দেখা হয় না- তোমার লগে আমার- মনে তো কয় একলগেই আছি- খালি সামনাসামনি দেখা হয় না।
ওই যে ইকাত্তর- সংগ্রামের সন আইলো, মিলিটারি নামলো- উনিও ঘর থাইকা বাইর হয়!
বুড়া পাকুড় গাছের বাকল ফাইটা ফাইটা আমার কপালের লাহান হইয়া গেল- পাকুড় গাছের ভাঙ্গা ডালে বারি দিয়া কতোবার ঘুন্নিবাই আইলো- খালি তাইন আইয়ে না!
ফিনকি দিয়ে গল্পটি দরজার মুখে আসে
কৌরাল কাঁদিয়া ডাকিছে তিনপ্রহর নিশীথিনী বনে
নিঃসহায় রেখাপাত তার নয়নকোণে!
পদকমলে নিঙারি নিঙারি ঝরে,
আহা জলমোচর বসন্ত!
নক্ষত্রতারাদের সহমর্মসহ বিহবলতা দাঁড়ায়
কোজাগরি রাত্রির দুহিতাসকল,
পুত্ররা অবধি- কন্যাকুমারী বরুণ শাখার নরম সংবেদনায় হলাহল;
সহদূরাভিগামী মা দুর্গা, জননী ফাতেমা- মাতৃধারা,
ও আমার আকনমেন্দি পাতা!
বৃক্ষতল আর কুয়াশাআঁধির এক সঙ্গীন অতল
বল্কলপরা অনাদিকাল মোহনায় হাসানের ঘোড়ার পিঠে দেখো দেখো আশাস্থির অর্জুন আসে!
পুত্র তোমার- কাদা আর পাটফুলের মর্মে,
মৃত্তিকামূলে বোবাধরা জ্যোৎস্নাওড়া কালে!
ওম বিলীয়মান স্মৃতির শিমূল- আভূমি পদচিহ্ন,
পূর্বপুরুষের রক্তপাতের নামে কথা দেবার চিঁহি।
ওম শোনিত লৌ রক্তকল্যাণধারা; কে জানে আবার
কোথায় কোন গঞ্জের কলরব মাথায় একাত্তর
গল্পআকুতির হারানো অ্যাগোনি: ফিনকি দিয়ে গল্পটি
দরজার মুখে আসে;
ওম গর্ভবতী পাথর কাতরায় শিহরণ লাগি!
৫৬ হাজার বর্গমাইল
একটি মানব শিশু যে-মুহূর্তে জন্ম নেয় ঠিক সেই মুহূর্তেই তার সম্পূর্ণ জন্মগ্রহণের ঘটনাটি ঘটে না।
প্রত্যেকটি জন্মই একটি ইতিহাস ও পরম্পরার ঘনীভূত রূপ: সেখানে অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যত একবিন্দুতে এসে একান্নবর্তী হয়; ১৯৭১ সনের ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের ভিতর দিয়ে বাঙলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের অন্তরাত্মায় একবিন্দু আগুন ও অশ্রুকণার সম্মিলনে ভারতভাগের কাটা দাগের ক্ষরণের মধ্যে একটি আকাঙ্ক্ষার প্রসূন তার মুখ বাড়িয়ে ধরে। ফলে বাঙলাদেশ নাম ৫৬ হাজার বর্গমাইল আয়তনের ক্ষুদ্রকায় এক উদিত দুঃখের দেশ- যে বটবৃক্ষের বীজের সঙ্গে তুলনীয়- দেখতে ছোট, কিন্তু ধারণ ও ব্যক্তিত্বে অসীম।
ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামের ভিতর দিয়ে যে ভারতবর্ষের জন্ম হবার কথা ছিল- বাস্তবে সেই ভারত উত্থিত ও গঠিত হবার বদলে রক্তপাত আর খণ্ডবিখণ্ডতার আর্তনাদে পরিসমাপ্ত হয়।
বাঙলাদেশের জন্ম সেই অসমাপ্ত স্বপ্নের বাস্তব অভিব্যক্তি।
আকাঙ্ক্ষার এই সুবিশাল চাপের মধ্যে বাঙলাদেশ বুঝি পাথরের নিচে চাপাপড়া রাজকুমারের মত হাঁসফাঁস করে!
এই অগ্নিপরীক্ষা মোকাবেলায় লক্ষ লক্ষ মুক্তিযোদ্ধা অঙ্গীভূত হোক একজন মুক্তিযোদ্ধায়, ২ লক্ষ বীরাঙ্গনা মিলে ১জন বীরাঙ্গনাকে প্রার্থনার পবিত্রতায় আমরা যেন হৃৎস্পন্দনের উন্মিলনে গ্রহণ করি, ৩০ লক্ষ শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ১জন মুক্তিযোদ্ধা হয়ে আমাদের সঙ্কল্পের দৃঢ়তায় একাকার হোক।
আমাদের আলাদা আলাদা কোন জন্মদিন নেই; আমরা সবাই জন্মেছি একদিনে – আমাদের একটাই জন্মদিন- ১৬ই ডিসেম্বর।
যেতে হবে দূর ঘুমিয়ে পড়ার আগে: এক পরিপূর্ণ শিশু, এক অপরিপূর্ণ জননী, তোমাকে প্রণতি জানাই!