আত্মহত্যা প্রবনতা বেড়েই চলেছে । এইচ বি রিতা
নিউজ টাইমস ২১ ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ১১ এপ্রিল ২০২১, ১১:২০:০৪ অপরাহ্ন
আত্নহত্যা বর্তমানে এক সামাজিক ব্যাধিতে পরিনত হয়েছে। এর সাথে মানসিক অসুখের সম্পর্কগুলো খুব ওতপ্রোতভাবে জড়িত। প্রেমে ব্যর্থতা, সম্পর্কের পতন, স্বামী স্ত্রীর কলহ,পরীক্ষায় ব্যর্থতা, মায়ের বকুনি, বাবার কড়া শাসন, অভাব, অপ্রাপ্তি, এমনকি বন্ধুর সাথে ঝগড়ার মত সামান্য ব্যপারগুলো থেকেও আমরা খুব বেশী আবেগী এবং বিষণ্ণ হয়ে পড়ছি আমরা। বেঁছে নিচ্ছি আত্নহত্যার পথ। আমরা আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিনা, পরিবেশের সাথে সময়ের দাবী বা প্রকৃতির বৈরিতাকে মানিয়ে নিতে পারছিনা।
যোগের বিজ্ঞান যদিও বলছে সবসময় বর্তমান ধরে থাকো, কিন্তু আমরা ঘুরে ফিরে সেই অতীত এবং ভবিষ্যতেই হিসাব মেলাবার চেষ্টায় থাকি। অথচ ভবিষ্যৎ এক কল্পনা মাত্র এবং অতীতের কোন অস্তিত্বই নেই।
বেঁচে থাকা যখন কোন কারণে অসহনীয় উঠে এবং তা থেকে মুক্তির কোন পথ আমরা খুঁজে না পাই, তখনই ঘটতে থাকা প্রবাহমান নিত্য যন্ত্রণাগুলো থেকে মুক্তির আশায়, মৃত্যু পরবর্তি অনিশ্চয়তাকেই আমরা একমাত্র অবলম্বন হিসাবে বেছে নিচ্ছি।
ইসাইডোলজি, মনস্তাত্ত্বিক ও বিশেষজ্ঞদের মতে, মানসিক অসুস্থতা আত্মহত্যার অন্যতম প্রধান কারণ। বিশেষজ্ঞ মাইকেল মোসকোস, জেনিফার অ্যাকিলিস ও ডগ গ্রের মতে, আত্মহত্যার কারণগুলোর মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক, পরিবেশগত ও সামাজিক কারণ রয়েছে। হতাশা, বিষণ্ণতা, উদ্বিগ্নতা, আত্মবিশ্বাস হারানো, বিচার ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া, আবেগ নিয়ন্ত্রণে দুর্বলতা…বিভিন্ন বিষয়গুলো আমাদের আত্মহত্যার ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে। সুস্থ্য মানুষের পক্ষে কখনো এই পথ বেঁছে নেয়া সম্ভব নয়। আত্নহত্যার প্রবণতা এক ধরণের মানসিক সমস্যা। আর এ সমস্যা তৈরী হয় প্রচন্ড ক্রোধ, আবেগ ও অপ্রাপ্তি থেকে।
একজন মানুষ যখন মনে করেন যে তিনি বেঁচে থাকার সমস্ত উপকরণ হাড়িয়ে ফেলেছেন এবং তার চলে যাওয়ায় পৃথিবীর কিছু যায় আসেনা, তখনই তিনি আত্নহত্যার পথ বেছে নেন! এটা তার অভিমান। সেই অভিমান যে ভুল, তা বিচার করার মত মানসিক ক্ষমতা তার থাকেনা।
আবার অনেকেই জীবনের কঠিন মুহুর্তগুলো থেকে মুক্তির পথ খুঁজে না পেয়ে, পারিবারিক সহায়তার অভাবে, একাই নিজের জীবনের সমাপ্তি টানতে এই পথ বেছে নেন।
কেউ কেউ তার ভুল কোন পদক্ষেপের মাশুল হিসাবে আত্নহত্যা করেন।
মানসিক অবসাদ ও বিষাদ্বের পাশাপাশি আত্মহত্যার আরো একটি সুক্ষ কারণ, যা মানুষকে সহজেই আত্নহননের পথে ঠেলে দেয়, তা হলো নিঃসঙ্গতা। অনেক সমাজবিদরা মনে করেন নির্দিষ্ট কিছু সামাজিক বিধিবিধান অনুসরণ করা থেকেই নিঃসঙ্গতার উৎপত্তি। আবার কিছু সাইকোলজিস্ট মনে করেন ব্যক্তিগত সম্পর্ক স্থাপনে ব্যর্থতা, নিজের অনুভূতির যথার্থ প্রকাশ না করতে পারা এবং অধীনস্থ সামাজিক প্রক্রিয়া থেকেই নিঃসঙ্গতা বা একাকিত্বের অনুভূতি চরম আকার ধারণ করে। নিঃসঙ্গতার সঙ্গে সংযুক্ত থাকে মানুষের মনের সাধারণ অসন্তোষ,অসুখী, বিষণ্ণতা, উদ্বেগ, শূন্যতা ও একঘেয়েমি অনুভূতি।
কারণ যাই হোক, আত্নহত্যা কোন সমাধান হতে পারেনা। ধর্মীয় দিক থেকে দেখলে, কোরআনে বলা হয়েছে আত্নহত্যা মহাপাপ। এ বিষয়ে সতর্ক করে মহান রাব্বুল আল-আমীন বলেন, “আর তোমরা নিজেদের হত্যা করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি দয়ালু। এবং যে কেউ জুলুম করে, অন্যায়ভাবে উহা (আত্মহত্যা) করবে, অবশ্য আমি তাকে অগ্নিদগ্ধ করবো, আল্লাহর পক্ষে উহা সহজসাধ্য।” (সূরা-নিসা-২৯-৩০)
হিন্দু ধর্মে ঈশ উপনিষদে আত্মহত্যাকারী মৃত্যুর পর আনন্দহীন লোকে গমন করবে বলে সাবধান করা হয়েছে। বলা হয়েছে, “অনন্দা নাম তে লোকা অন্ধেন তমসাবতাঃ।
তাংস্তে প্রেত্যাভিগচ্ছন্তি যে কে চাত্মহনো জনাঃ।।”( ঈশ উপনিষদ,৩)। অর্থাৎ – অন্ধকরা অন্ধকারে আবৃত একটি লোক আছে। তার নাম অনন্দলোক। যারা আত্মহত্যা করে তারা মৃত্যুর পর সেই লোকে যায়।
খ্রিষ্টান ধর্ম আত্মহত্যাকারী স্বর্গে প্রবেশ করতে পারবে কিনা, সে সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছু বলা হয়নি। তবে বলা হয়েছে, আত্মহত্যাকারী নিজের যাত্রা নরকের দিকে তরান্বিত করা ছাড়া আর কিছুই করলনা। বাইবেল অনুযায়ী অত্মহত্যা হচ্ছে ইশ্বরের বিরুদ্ধে করা ভয়ানক পাপ।
“অহিংসা পরম ধর্ম, জীব হত্যা মহা পাপ” গৌতম বুদ্ধের এই মতবাদের প্রথম লাইনে উল্লেখ্য করা হয়েছে যে, জীব হত্যা মহাপাপ। তাই বৌদ্ধ ধর্মেও আত্মহত্যা পাপ গন্য করা হয়।
আত্মহত্যা কোনো অবস্থাতেই কাম্য হতে পারে না। আত্মহত্যার মাধ্যমে একটি জীবনই শুধু নষ্ট হয় না, একটি পরিবার ও আত্মহত্যাকারীর আপনজন -বন্ধু-বান্ধবদের উপর ও এর বিরুপ প্রভাব পরে।
এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, আত্মহত্যাকারীদের দুই-তৃতীয়াংশই আত্মহত্যার পুর্বে নিজেদের ইচ্ছা সম্পর্কে অন্যের কাছে কম-বেশী তথ্য দিয়ে থাকেন। ওসব তথ্যকে নজরে রেখে, পরিবার বা বন্ধু-বান্ধব সকলেই যদি সতর্ক থাকে এবং সময়মত যথাযত ব্যবস্থা নেয়, তাহলে অনেক ক্ষেত্রে এ ধরণের দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব হতে পারে। প্রয়োজনে ডাক্তার বা কাউন্সিলিং এর ব্যাবস্থা করা যেতে পারে।
তার পাশাপাশি, প্রতিটা পরিবারে কিংবা সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমাদের মনে রাখতে হবে, একে অপরের প্রতি সদয় মনোভাব রাখতে হবে। সমস্যা হতেই পারে। দুঃখ-কষ্ট নিয়েই আমাদের জীবন। সেটাকে সাহসের সাথে মোকাবিলা করাই বুদ্ধিমানের কাজ। একে অপরের প্রতি যত্নশীল হতে হবে। একে অন্যকে মত প্রকাশের স্বাধীনতা দিতে হবে, চাহিদা, ইচ্ছে, শখ, কষ্ট, মেধা সবকিছু জানার চেষ্টা করতে হবে। বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে হবে, যেন সবকিছু খোলা মনে শেয়ার করা যায়। ভালো–মন্দ, ন্যায়–অন্যায়, নৈতিকতার সঠিক শিক্ষায় একটা অবকাঠামো গঠন করা আমাদের প্রত্যকের জীবনে, পরিবারে এবং সম্পর্কের ক্ষেত্রে খুব জরুরী। যে কোন মানসিক সমস্যা থেকে সেরে উঠতে পরিবারের সহযোগীতা একটা মহাঔষদ।
আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, বিভিন্ন ধর্মেও আত্মহত্যা নিয়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। যে কোন ধর্মকে গুরুত্ব দেয়া আমারা যদি সামাজিক ও নৈতিক শিক্ষার পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষা ও সচেতনতা কিছুটা বৃদ্ধি করতে পারি নিজ পরিবারে, তবে সেটাও হয়তো আত্মহত্যার প্রবণতা কমাতে কিছুটা সাহায্য করতে পারে।
তবে সর্বপ্রথম মানুষিক সমস্যার লক্ষণগুলো প্রকট হয়ে উঠলে অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। প্রয়োজনে কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।
লেখক পরিচিতিতে এইচ বি রিতা, লেখক, সাংবাদিক, কলামিস্ট, শিক্ষক